মশার উপদ্রব আর কতকাল! Latest Update News of Bangladesh

বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০৯:২৩ অপরাহ্ন

বিজ্ঞপ্তি :
Latest Update Bangla News 24/7 আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি ভয়েস অব বরিশালকে জানাতে ই-মেইল করুন- [email protected] অথবা [email protected] আপনার পাঠানো তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করে আমরা তা প্রকাশ করব।*** প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে!! বরিশাল বিভাগের সমস্ত জেলা,উপজেলা,বরিশাল মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ড ও ক্যাম্পাসে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে! ফোন: ০১৭৬৩৬৫৩২৮৩




মশার উপদ্রব আর কতকাল!

মশার উপদ্রব আর কতকাল!




তসলিমা নাসরিন:
ডেঙ্গি হয়েছিল আমার। ২০১৪ সালে। সাত দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। ডেঙ্গি আমার লিভার নষ্ট করেছে আর ডায়াবেটিস এনেছে। লিভার ফাংশন টেস্ট আর ব্লাড সুগার প্রায় তিনশ’র কাছে চলে গিয়েছিল। ডেঙ্গি হওয়ার আগে কিন্তু আমার সব টেস্ট ঠিকঠাক ছিল। ডাক্তার বলেছিলেন ডেঙ্গি সেরে যাওয়ার পর লিভার আর প্যানক্রিয়াস আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। ডেঙ্গি ভাইরাস বিদেয় নিয়েছে, লিভার আর প্যানক্রিয়াস আগের অবস্থায় আজও আসেনি। ডাক্তাররা বুঝেছেন, আর আসবেও না ওসব আগের অবস্থায়। প্রতি বছর ডেঙ্গির চরিত্র বদলাচ্ছে। একেক বছর একেক রকম ক্ষতি করছে। একজন ডাক্তার সেদিন আমাকে বললেন, ‘তোমার বোধহয় ২০১৪ সালে হওয়া ডেঙ্গিটা দ্বিতীয় ডেঙ্গি ছিল। প্রথম ডেঙ্গি হয়তো চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল, টের পাওনি। দ্বিতীয় ডেঙ্গিই ভয়ঙ্কর হয়। ভেতরের কলকব্জায় থাবা বসায়। তৃতীয় তো হামেশাই মৃত্যু ডেকে আনে।’ অনেকটা হার্ট অ্যাটাকের মতো, প্রথম আর দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকের পর কায়ক্লেশে বেঁচে গেলেও তৃতীয়টায় বাঁচা সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশে বন্যা হচ্ছে। বন্যায় ভেসে ভেসে নানা রোগ আসে। ডায়রিয়া কলেরা ইত্যাদি তো বাঁধা। ১২ হাজার লোক পেটের রোগে ভুগছে বাংলাদেশে। এসবের মধ্যে এ বছর আবার ডেঙ্গির উপদ্রব। মনে আছে, যখন ময়মনসিংহ শহরের এস কে হাসপাতালে চাকরি করতাম, বন্যার পর পর প্রতিদিন শত শত কলেরা রোগীর চিকিৎসা করতাম। হাসপাতালটি সংক্রামক রোগের হাসপাতাল ছিল। প্রতিদিন রোগীদের স্যালাইন লাগিয়ে কূল পেতাম না। ওদিকে ব্রহ্মপুত্র-পাড়ের মানুষদের ত্রাণ বিতরণ করছি, এদিকে চিকিৎসা করছি। চোখের সামনে মরে যেত রোগী, চোখের জল মুছতে মুছতে আরেক রোগীকে প্রাণপণে চেষ্টা করতাম বাঁচাতে।

আমার মনে হয় কলেরা বা ম্যালেরিয়ার চেয়ে ডেঙ্গি ভয়ঙ্কর। প্রতিদিন, শুনেছি, গড়ে ৬৫০ জন মানুষ ডেঙ্গি-জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। সরকারি হিসেবে ১০ হাজার ডেঙ্গি রোগী এখন বাংলাদেশে। হিসেবে নেই, এমন রোগীর সংখ্যা যোগ করলে নিশ্চয়ই দ্বিগুণ হবে সংখ্যা। ডেঙ্গি মশা নাকি কোনও ওষুধেই মরছে না। অবাক লাগে, বাঘ ভালুক নয়, মানুষের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শিকারি ছোট্ট মশা। কামান দাগালেও মশা মারা যায় না। এমনকী ২৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে যে সাবমেরিন কেনা হয়েছে, সেই সাবমেরিন দিয়েও কোনও ডেঙ্গি মশার একটি পাখারও কোনও ক্ষতি করা যাবে না। ছোট্ট মশারা বড় বড় মানুষ মেরে ফেলছে। জামালপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসব অঞ্চলে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১২০। মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে হয়তো। মানুষ কেন মশা নির্মূল করতে পারছে না? ভারত চন্দ্রযান পাঠিয়ে দিয়েছে প্রায় চার লাখ কিলোমিটার দূরের চাঁদে জল আছে কিনা পরীক্ষা করতে, কিন্তু ভারতের ভেতরেই মানুষ খাবার জলের অভাবে ভুগছে। বাংলাদেশ তো নানা হাবিজাবি খাতে টাকা-পয়সা খরচ করছে। অথচ মানুষের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর শিকারি মশাকে দূর করতে পারছে না। মশাকে দূর করতে না পারলে ডেঙ্গি দূর হবে না। সাফ কথা।

১০ কোটি বছর ধরে এই পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে মশা। মেয়ে-মশারা তাদের ডিমের বৃদ্ধির জন্য মানুষের রক্ত পান করে। কালো সাদা হলুদ বাদামি ছোট বড় সবারই রক্ত তাদের চাই। অনেক প্রাণনাশক রোগ তারা বহন করে, এগুলোর মধ্যে আছে ম্যালেরিয়া, জিকা, পশ্চিম নাইল, ইয়েলো ফিভার, ডেঙ্গি। মশা গবেষক টিমথি ওয়াইনগার্ড বলেছেন মশারা সাত লাখ মানুষকে প্রতি বছর হত্যা করছে।

কয়েক বছর ধরে গবেষণা চলছে ঘাতক মশা নির্মূল করার জন্য। মশার জিন বদলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন বিজ্ঞানীরা। মশারা এমন জিন পাবে, যে জিনের কারণে জন্ম দেবে বন্ধ্যা সন্তান, বন্ধ্যা সন্তান জন্মাবে, কিন্তু আর কোনও সন্তান তারা জন্ম দিতে পারবে না। এভাবেই, সম্ভবত একমাত্র এভাবেই বিলুপ্ত করা সম্ভব মশা নামের প্রজাতিকে। কিন্তু যারাই আমাদের অপকার করছে, তাদের যদি ধ্বংস করে ফেলি, তাহলে কি প্রকৃতি থাকবে? অনেকে প্রশ্ন করছে আমরা কি ডিজনিল্যান্ডে বাস করতে চাই, নাকি প্রকৃতিতে! সেও ঠিক। প্রকৃতিতে শুধু মানুষ থাকবে কেন, অন্যান্য সব প্রাণীও থাকবে। প্রাণীদের কেউ কেউ আমাদের বন্ধু, কেউ কেউ শত্রু। মশা সম্ভবত সবচেয়ে বড় শত্রু। আমাদের ল্যাবে জিন থাকলে আমরা উলি ম্যামথ বা ডায়নোসরকেও জগতে ফিরিয়ে আনতে পারি। মশাকে যদি এমনই দরকার হয়, তাহলে যেসব মশা কামড়ায় না, সেসব মশাকেও কিন্তু ফিরিয়ে আনতে পারি, যদি প্রকৃতির জন্য এতই ব্যাকুল হই।

মশাকে যদি বিলুপ্ত করি, মশাবাহিত রোগে আমরা ভুগবো না বটে, কিন্তু অন্য কোনও পোকা মাকড়, অন্য কোনও পতঙ্গ নতুন কোনও প্রাণনাশক রোগ নিয়ে উপস্থিত যে হবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা আছে? আমরা কি তবে একের পর এক প্রজাতি বিলুপ্ত করেই যাবো? যে যাই বলুক, আমি কিন্তু মশার বিলুপ্তির পক্ষে। পৃথিবী থেকে বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তাতে প্রকৃতির ভারসাম্য কিছু মাত্র নষ্ট হয়নি। এখন মশা বিলুপ্ত হলে নতুন কোনও প্রাণনাশক প্রাণীর জন্ম হতে পারে, সে কারণে কি মশাকে বিলুপ্ত করবো না? প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা বলতে অনেকে কিন্তু মানুষের মৃত্যুকে বোঝায়। মানুষকেও তো মরতে হবে, তা না হলে পৃথিবীর মতো ছোট একটি গ্রহে এত মানুষের জায়গা কী করে হবে! মানুষ একসময় ২০ বা ২১ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে মারা যেত। আমরা কি যক্ষ্মাকে জয় করিনি? ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার মরণ থাবা থেকে কেন বাঁচতে চাইবো না?

লিভারপুলের ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ডিন ডক্টর রুবার্ট বয়েছ ১৯০৯ সালে বলেছিলেন, মানব সভ্যতা টিকে থাকবে কি না, তা নির্ভর করছে একটি প্রশ্নের ওপর, ‘মানুষ না মশা?’ রুবার্ট বয়েছের প্রশ্নের উত্তরে আমি বলবো, মানুষ। আমি জানি মানুষ কোনও আহামরি প্রজাতি নয়। কিন্তু মশার চেয়ে তো অনেককে নিঃসন্দেহে ভালো বলা যায়। আমি খারাপ মানুষদের কথা বলতে চাইছি না, ওরা ডেঙ্গি মশার চেয়ে শতগুণে খারাপ, এতে আমার কোনও দ্বিমত নেই। ডেঙ্গি যত ক্ষতি করে মানুষের, মন্দ লোক তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করে সাধারণ মানুষের।

শুনছি হাঁটি হাঁটি পা পা করে এবোলা আসছে আমাদের আংগিনায়। এবোলা শুরু হয়েছিল গিনিয়া আর গণপ্রজাতন্ত্রী কংগোতে। এ পর্যন্ত ১১ হাজারের চেয়ে বেশি লোক মরেছে আফ্রিকায়। এবোলা তো মারাত্মক প্রাণনাশক, এবোলার সঙ্গে অন্যান্য প্রাণনাশক ভাইরাসও আসছে, ইয়েলো ফিভার আসছে, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা আসছে। এবোলা সাংঘাতিক সংক্রামক। এবোলা শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ করিয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটায়। ডেঙ্গিতে না হয় কখনও কখনও বাঁচা যায়, এবোলাতে মৃত্যু প্রায় অবধারিত। মনে আছে কয়েক বছর আগে আমেরিকায় সদ্য আফ্রিকা ফেরত এক লোককে পাওয়া গিয়েছিল যার শরীরে এবোলা ছিল। লোকটি আফ্রিকায় গিয়েছিল এবোলায় আক্রান্ত মানুষদের সেবা করতে, ফিরেছে এবোলা নিয়ে। তাকে নিউ ইয়র্কের বেল্ভিউ হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। হাসপাতালে কাউকে তখন ঢুকতেই দেওয়া হচ্ছিল না। হাসপাতাল ঘিরে ছিল মিডিয়ার লোক। মুহূর্তে মুহূর্তে খবর নিচ্ছিল এবোলা আক্রান্ত লোকটির কী অবস্থা, এবোলা কি আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়বে! এবোলা আক্রান্ত লোকটিকে সম্পূর্ণ একা একটি ঘরে রাখা হয়েছিল, তার আশপাশে কোনও ডাক্তার বা নার্সকে যেতে হলে নভোচারীদের পোশাক পরে যেতে হতো।

ভারতের ৩০,০০০ লোক বাস করে উগান্ডায়। উগান্ডায় এবোলা আছে সেই খবর পাওয়া গেছে। ভারতের লোকেরা উগান্ডা থেকে ভারতে আসছে। ভাইরাসও তাদের সংগে আসছে। ভারতে ভাইরাস এলে, তা বাংলাদেশে আসবেই। ভারত রাজনৈতিকভাবে এক দেশ না হলেও রোগ-শোকের বেলায় কিন্তু এক দেশ। ভারতে বন্যা হলে বাংলাদেশেও বন্যা হবে, ভারতের হাওয়া দূষিত হলে বাংলাদেশের হাওয়াও দূষিত হবে, ভারতে ভাইরাস এলে বাংলাদেশেও আসবে।

লেখক: নির্বাসিত লেখিকা

সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার করুন



Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *










Facebook

© ভয়েস অব বরিশাল কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed BY: AMS IT BD